ভাওয়াইয়া গান

491
Gurur-Gari
গরুর গাড়ি

ভাওয়াইয়া বাংলাদেশের অন্যতম লোকঐতিহ্য। আমাদের সঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

ভাওয়াইয়া হচ্ছে দেশের উত্তর অঞ্চলে প্রচলিত এক ধরনের বিশেষ রীতির গান। রংপুর জেলা ও সংলগ্ন অঞ্চল তথা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটকে এ গানের জন্মস্থান মনে করা হয়। ভারতের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি অঞ্চলেও এ গানের বেশ প্রচলন রয়েছে।

ভাওয়াইয়া গানে উত্তরবঙ্গের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, জীবনপ্রণালী নানাভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে গরুর গাড়ি, গাড়িয়াল বা গরুর গাড়ির চালক, রাখালদের জীবনগাঁথা বেশ প্রাধান্য পেয়েছে।

কয়েক দশক আগেও দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালো ছিল না। গ্রামীণ জনপদে ছিল না ইট-পাথরের পাকা সড়ক। ওই সড়কে ইঞ্জিনের গাড়ি চলার কোনো জো ছিল না। গ্রামীণ ওই জনপদে গরু ও মহিষের গাড়িই ছিল প্রধান বাহন। মাঠ থেকে পাকা ধান কেটে বাড়ি নিয়ে আসা, বাজার ও হাট থেকে পণ্য আনা-নেওয়া, কোনো দূর গাঁয়ে যাওয়া, এমনকি নব বধূর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসাও গরুর গাড়িতেই হতো বেশী। সম্পন্ন কৃষক বাড়িতে মজুর হিসেবে থাকা দরিদ্র মানুষ এসব গাড়ি চালাত। অনেকে নিজের গাড়ি নিয়ে অন্যের ভাড়া খাটত।

অন্যদিকে অবস্থাসম্পন্ন (ধনী) কৃষকদের অনেকেরই অসংখ্য গরু-মহিষ থাকতো। আর এসব গরু-মহিষ চড়ে বেড়াতো দূরের কোনো সবুজ মাঠে। নদীর বুকে জেগে উঠা চরে। যোগাযোের দিক থেকে এসব চর ছিল অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। জনবসতিহীন ওইসব চরে তেমন কোনো ফসলও ফলতো না।

চরের কোনো এক প্রান্তে ছোট্ট কুঁড়েঘর হতো রাখালের বাস। সকালে গরু বা মহিষের পালকে বাথান থেকে নিয়ে মাঠে ছেড়ে দেওয়ার পর তেমন কিছুই করার থাকতো না তার। বিশেষ করে উদাস দুপুরে গাছের ছায়ায় কাটতো অলস সময়। উদাসী হাওয়ায় উথাল-পাতাল করে উঠতো তার বুক। দূর গাঁয়ে রেখে আসা বউ কিংবা পছন্দের মানুষটির জন্য বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করতো। শুয়ে শুয়ে কল্পনার চোখে দেখতো তার স্ত্রী কিংবা প্রিয় মানুষটিও তার বিরহে ব্যাথাতুর। বিষন্ন। কল্পনায় দেখতো বাঁশঝাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে প্রিয় মানুষটি বুঝি তার অপেক্ষায় পথের দিকে তাকিয়ে আছে। তার এ ভাবনা আর কল্পনাই গান হয়ে উঠে আসতো গলায়। আর এ গানই ভাওয়াইয়া গান।

মৈষাল, গাড়িয়াল, মাহুত ইত্যাদি ভাওয়াই গানের প্রধান চরিত্র। মৈষাল হচ্ছেন তিনি যিনি মহিষ চড়ান। মৈষাল মূলত মৌসুমী শ্রমিক। সাধারণত এক মৌসুম, কখনো বছরভিত্তিক চুক্তির আলোকে কাজ করেন তারা। গ্রামের ধনী মানুষের মহিষের পাল তিনি দেখভাল করেন। গাড়িয়াল হচ্ছেন তিনি, যিনি গরু বা মহিষের গাড়ি চালান। অন্যদিকে মাহুতও এক প্রকার রাখাল। তিনি হাতি লালনপালন করেন। হাতির পিঠে চড়ে হাতিকে চালিয়ে নেন। হাতি দিয়ে মাল পরিবহণ করেন।

ভাওয়াইয়া গান ভাব প্রধান। অর্থাৎ এই গানে ভাব অনেক বেশি। এই ‘ভাব’ থেকে ‘ভাওয়াইয়া’ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে অনুমান করেন।

কারো কারো মতে, ভাওয়া শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া এসেছে। ভাওয়া হচ্ছে কাশবন ও নলখাগড়ার বনে আচ্ছাদিত চর।

আবার অনেকের মতে, বাউদিয়া নাম থেকে ভাওয়াইয়া নামটি এসেছে। বাউদিয়া নামের উদাসী সম্প্রদায় মূলত এ গানের রূপকার।

জনপ্রিয় ও অতি পরিচিত কয়েকটি ভাওয়াইয়া হচ্ছে-

ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে….কোনদিন আসিবেন বন্ধু, কয়া যাও কয়া যাও রে

ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে

গেইলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধু রে

বাথান বাথান করেন মৈষাল

ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে

তোরষা নদী উথাল পাতাল কারবা চলে নাও

যে জন প্রমের ভাব জানে না, তার সঙ্গে নাই লেনাদেনা

প্রয়াত শিল্পী আব্বাস উদ্দিনকে ভাওয়াইয়া গানের রাজা বলা হয়। তিনি এই গানকে জনপ্রিয় করার আগে ভাওয়াইয়াকে একেবারেই চাষাভুষাদের গান বলে তাচ্ছিল্য করা হতো। আব্বাস উদ্দিন গাওয়ার পর এই গান দুই বাংলায় পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। শিক্ষিত সুধীজনদের মনোযোগে আসে। ভাওয়াইয়া গানের ঐশ্বর্য দেখে অনেকে চমকে উঠেন।

পরবর্তীতে এ বাংলায় হরলাল রায়, রথীন্ত্রনাথ রায়ের মাধ্যমে ভাওয়াইয়া গানের চর্চার ব্যাপ্তি বাড়ে।

মন্তব্য