খুঁজে পাওয়া পুরনো শহর মাচুপিচু

358
Machu-Picchu-Peru
পেরুতে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন মাচুপিচু

মানব সভ্যতা অনেক এগিয়েছে। কত কী-ই না আবিষ্কার করেছে মানুষ। গড়ে তুলেছে জৌলুসময় আধুনিক নগরী। এসব দেখে আমরা নিজেদেরকে অনেক অগ্রসর ভাবছি। কিন্তু আজ থেকে হাজার বছর আগেও কিন্তু অনেক অগ্রসর মানুষ ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এতোটা বিকাশ না হওয়া সত্ত্বেও তারা গড়ে তুলেছিল সুন্দর শহর। এসব শহরের বেশিরভাগই ধংস হয়ে গেছে নানা কারণে। আবার কিছু শহর গিয়েছিল হারিয়ে। পরে খুঁজে পাওয়া গেছে। এমনই এক শহরের নাম মাচুপিচু।

Machu-Picchu-Sunrise
মাচুপিচুতে সূর্যোদয়

ইনকা সভ্যতার কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। মাচুপিচু এই সভ্যতার সময়ে নির্মিত একটি শহর। ইনকা সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন। অন্যতম বলছি এ কারণে যে, ইনকারা এমন আরও কয়েকটি শহর গড়ে তুলেছিল বলে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা। নানাভাবে সে সব শহর ধংস হয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগই অবশ্য ধংস করেছে স্পেনিস লুটেরা-দখলদাররা। তারা ইনকাদের অগাধ ধনসম্পদের লোভে দিনের পর দিন সেখানে অভিযান চালিয়েছে। হামলার পর হামলা আর নানা চাতুর্যের মাধ্যমে ইনকা সাম্রাজ্য দখল ও শহরসহ নিভিন্ন স্থাপনা ধংস করেছে। অলৌকিকভাবে তাদের বর্বর হামলা থেকে রক্ষা পায় মাচুপিচু।

ইনকা সভ্যতা কী?

প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ধরে প্রায় আড়াই হাজার মাইল জুড়ে আন্দিজ পর্বতমালার বিস্তার। আর এই আন্দিজ ও তার পাদদেশেই গড়ে উঠেছিল ইনকা সভ্যতা। আজকে আমরা যাদেরকে রেড ইন্ডিয়ান বলে জানি, তাদেরই একটি ধারা ইনকা সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর কুস্কো শহরকে কেন্দ্র করে ইনকা সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে বলিভিয়া, উত্তর আর্জেন্টিনা, চিলি ও ইকুয়েডর পর্যন্ত। তাদের হাত ধরে পুরো অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল অবাক করা সভ্যতা। ১২০০ শতকের দিকে এই সভ্যতার শুরু। ১৫৩২ সালের দিকে স্পেনীয় দখলদারদের তান্ডব, মহামারি ও খরাসহ নানা কারণে অল্প সময়ের মধ্যে পুরো সভ্যতাটি ধংস হয়ে যায়। রহস্যজনকভাবে শুধু টিকে যায় মাচুপিচু।

মাচুপিচু কোথায়?

পেরুর দক্ষিণ-পশ্চিমে আন্দিজ পর্বতমালার উরুবাম্বা উপত্যকার উপরে একটি পর্বতচূড়ায় গড়ে উঠেছিল মাচুপিচু শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৪০০ মিটার বা প্রায় ৭,৮৭৫ উঁচু। ধারণা করা হয় এটি ১৪৫০ সালের দিকে নির্মিত হয়। শহরের পাশেই ছিল উরুবাম্বা নদী। মাচুপিচু আর ইনকাদের রাজধানী কুস্কো শহরের মধ্যে দূরত্ব ছিল ৮০ মাইলের মতো।

মাচুপিচুর বিশেষত্ব

মাচুপিচুর প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে এটি ইনকা সভ্যতার বিরল একটি নিদর্শন। দ্বিতীয় বিশেষ দিক হচ্ছে, এই শহরটি নির্মাণের পর পাঁচশ বছরেরও বেশী সময় পর্যন্ত বাইরের দুনিয়ার কেউ এর কথা জানতো না। এমন কি যে স্পেনিশরা, ইনকা অঞ্চল, বিশেষত পেরু দখল করে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছে, তারাও তাদের দীর্ঘ শাসনামলের মধ্যে মাচুপিচুর খবর জানতে পারেনি। আর এ কারণেই স্পেনিশদের নির্মম ধংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেয়েছে এই শহর।

মাচুপিচু নির্মিত হয়েছিল আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে। মসৃন পাথর, মাটির তৈরি ইট ও বিশেষ কাদামাটি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল বিভিন্ন স্থাপনা।

macchu-pichu-agri
মাচুপিচুতে পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে কেটে বাধানো চত্বর তৈরি করা হয়েছিল। এ চত্বরের উপরিভাগে রাখা হয়েছিল কৃষির উপযোগী মাটি। সেখানে ফসলের চাষ করা হতো

পাহাড়ের ওয়াইনা পিচু শৃঙ্গ থেকে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে এসেছে বিভিন্ন স্থাপনা। ধাপে ধাপে বাঁধানো চত্বরগুলো পাহাড়ের গায়ে এমনভাবে স্থাপিত যাতে মূল স্থাপনা ধসে না পড়ে। অনেকের মতে, এসব বাঁধানো চত্বরে ফসল ফলানো হতো যেহেতু বিশেষ কায়দায় এসব বাঁধানো চত্বরের উপরিভাগে কৃষি উপযোগী টপ সয়েল ব্যবহৃত হয়েছে।

মূল স্থাপনা, মন্দির, বেদি ও এক কক্ষবিশিষ্ট ঘরগুলোর দেয়াল পাথরের নিপুণ কারিগরি নিদর্শন।

শহরটিতে অবশ্য বেশি বসতি ছিল না। দু’শ এর মতো বসতি ছিল এখানে। আর তাতে বাস করতো হাজার খানেক মানুষ। সম্ভবত বসতির উদ্দেশ্যে এ শহর নির্মাণ করেনি ইনকারা। করলে পবর্তশৃঙ্গের মতো উঁচু জায়গা বেছে নিতো না। ধারণা করা হয়, ধর্মীয় শহর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল মাচুপিচুকে। উদ্দেশ্য-উপরে নিরিবিলি ও নির্বিঘ্নে উপাসনা করা। মাচুপিচুতে ছিল বেশ কয়েকটি মন্দির বা উপাসনালয়। এর মধ্যে প্রধান মন্দির ছিল সূর্য মন্দির।

এত প্রাচীনকালে চাকা বা লোহার আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া কীভাবে পাথরকে মসৃনভাবে কেটে স্থাপনাগুলো নির্মাণ করা হয় তা নিয়ে বিষ্ময়ের শেষ নেই।

বাইরের দুনিয়ার আড়ালে ছিল মাচুপিচু

নির্মাণের পর থেকে ১৯শ শতক পর্যন্ত বাইরের দুনিয়ার লোকজন মাচুপিচুর খবর জানতো না। এমনকি স্পেনিশরা পেরু দখল করে দীর্ঘদিন শাসন করলেও তারাও শহরটির খবর পায়নি। তাই তাদের তৈরি করা মানচিত্রে এই শহরের কোনো উল্লেখ নেই।

কেনো আড়ালে ছিল?

ইনকা সভ্যতার কোনো লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় না বলে পুরাতত্ত্বের বিভিন্ন নিদর্শনের পর্যালোচনা থেকে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অনুমান করা হয়। ধারণা করা হয়, স্পেনিশরা ইনকাদের অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে বিভিন্ন শহর ধংস করলেও মাচুপিচুর খবর তারা জানতো না। কিন্তু বর্বর স্পেনিশদের হাত থেকে রক্ষা পেলেও প্রকৃতির অপঘাত শহরটিকে ধংস করে দেয়। প্রচন্ড খরা আর তার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া মহামারিতে অল্প সময়ের ব্যবধানে মাচুপিচুর সব মানুষ মারা যান। মানবশুন্য শহরটিতে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠতে থাকে আগাছা। এক সময় ঘনজঙ্গলের নিচে পড়ে তা আড়াল হয়ে পড়ে।

তবে বাইরের দুনিয়া না জানলেও মাচুপিচুর আশপাশে বসবাস করা কিছু স্থানীয় মানুষজন পাহাড়ের চূড়ায় কিছু পাথরের স্থাপনার কথা জানতো।

যেভাবে খোঁজ মিলেছে মাচুপিচুর

কে, কখন মাচুপিচু খুঁজে বের করেন তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেকেই এই শহরটি প্রথম আবিষ্কার করেছেন বলে দাবি করেন। তবে বেশিরভাগ গবেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিরাম বিংহ্যাম মাচুপিচু আবিষ্কার করেন৷ তখন অবশ্য তিনি প্রভাষক পদে কর্মরত ছিলেন।

১৯১১ সালের ২৪শে জুলাই তিনি বৈজ্ঞানিক অভিযানে মাচুপিচুতে পৌঁছান৷ অবশ্য অনেকটা ঘটনা চক্রেই তিনি মাচুপিচু আবিস্কার করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি কয়েক বছর ধরে ইনকাদের শহর বিতকোস (Vitcos) ও ভিলকাবাম্বা (Vilcabamba) এর সন্ধান করছিলেন। বিতকোস ছিল পেরুতে স্পেনীয়দের আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বশেষ ইনকা প্রতিরোধের স্থান এবং ইনকাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল।

১৯১১ সালে বিংহ্যাম যখন মাচুপিচুর সন্ধান পান, তখন শহরটি এমন ঘন বন ও আগাছায় ঢাকা ছিল। ছবিটি বিংহ্যামের তোলা

বিংহ্যাম যখন বিতকোসের খুঁজে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখন ১৯১১ সালের কোনো এক সময়ে একজন রেড ইন্ডিয়ান, যিনি আবার কেচুয়া নামে একটি সম্প্রদায়ের মানুষ, বিংহ্যামকে পাহাড়ের চূড়ায় পাথরের তৈরি কিছু স্থাপনার ধংসাবশেষের কথা জানান। ১৯১১ সালে কেচুয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিংহ্যামকে মাচু পিচু শহরে নিয়ে যায়।

কেচোয়া সম্প্রদায়ের অনেক কৃষক পাহাড়ের কোলে চাষবাস আর পশু চরাতে এসে বিভিন্ন সময়ে শহরটির ধংবাবশেষ দেখতে পায়। তাদের মুখ থেকে বিষয়টি সম্প্রদায়ের অন্যদের কাছেও ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে কয়েকশ বছর ধরে স্থানীয়দের কাছে শহরটি পরিচিত হলেও বাকী বিশ্বের কাছে তা ছিল অজানা। বিংহামের ‘আবিষ্কারের’ পর শহরটির কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি মাচুপিচু শহর নিয়ে একটি বই লিখেন। তিনি বইটির নাম দেন ‘ইনকাদের হারানো শহর’।

জঙ্গল পরিস্কার ও কিছুটা খনন করার পর বের হয়ে আসে মাচুপচুর ধংসাবশেষ

তবে ঐতিহাসিকদের মতে, ইনকাদের হারানো শহর হচ্ছে, বিতকোস (Vitcos), যার আরেকটি নাম ভিলকাবাম্বা (Vilcabamba)। স্পেনিশ আক্রমণকারীদের হামলায় বিভিন্ন জায়গায় পরাজিত হয়ে সর্বশেষ বিতকোসে এসে আশ্রয় নিয়েছিল ইনকারা। কিন্তু স্পেনিশদের হাত থেকে এ শহরটিও রক্ষা করতে পারেনি তারা।

১৯৮১ সালে পেরুর সরকার মাচুপিচু ও আশপাশের ৩২৫.৯২ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে  “সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা” হিসেবে ঘোষণা করে। শহরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও এই এলাকায় অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। আর ১৯৮৩ সালে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো মাচুপিচুকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে।

শহর নবায়ন

দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় মাচুপিচুর ধংসাবশেষগুলোর অবস্থা ছিল নাজুক। এমন অবস্থায় সেগুলোকে চুড়ান্ত ধংস থেকে রক্ষা আর পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে সংস্কার ও পুনর্নির্মাণে হাত দেয় সরকার। কাঠামোগুলোর আদল ঠিক রেখে স্থাপনাগুলো মেরামত করা হয়। ১৯৭৬ সালে মাচুপিচুর সংস্কার ও নবায়ন শেষ হয়।

 

মন্তব্য

শেয়ার
পূর্ববর্তী নিবন্ধবাড়ির পথে
পরবর্তী নিবন্ধখনার বচন