ছোটদের ডায়াবেটিস: বদলাতে হবে জীবনধারা

241

মানবদেহ বড়ই অদ্ভূত। কতো না রহস্য লুকিয়ে আছে দেহের ভাঁজে ভাঁজে। এ দেহে পানি আছে, লবণ আছে, চিনি আছে, আছে লোহাসহ নানা পদার্থ। এর কোনো একটির কম-বেশি হলেই শরীর ছন্দ হারায়। দেখা দেয় নানা সমস্যা। তাই ছোট বেলা থেকেই এসব উপাদানের বিষয়টি জেনে নিতে পারলে একটু সাবধান, সতর্ক থাকা সম্ভব।

Junk-Food-Kids
শহরের শিশু-কিশোরদের মধ্যে ফাস্টফুডের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, যা তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে

ডায়াবেটিস কী

শরীরে শর্করা বা চিনিজনিত জটিলতায় সৃষ্ট এক ধরনের অসুস্থতার নাম ডায়াবেটিস। এটি হয় মূলত শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন নামের হরমোন তৈরি না হলে অথবা উৎপন্ন ইনসুলিনকে শরীর ঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে। এতে পরিপাকতন্ত্রের কার্যকারিতা কমে যায়। এতে শরীরে গ্লুকোজ বা শর্করা, সহজ কথায় চিনির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। শরীরে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়; আর তা প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে আসে।

ছোটদেরও কি ডায়াবেটিস হয়

এক সময় মনে করা হত, ডায়বেটিস বড়দের রোগ। ছোটদেরকে এ রোগ ছোঁয় না। এটি যে ভুল তা বেশ আগেই প্রমাণ হয়েছে। এখন বরং উদ্বেগ ছোটদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখে।

তবে এখনও অনেক অভিভাবক, এমন কি কোনো কোনো চিকিৎসকও এ বিষয়ে তেমন সচেতন নন। ফলে শিশু-কিশোর অসুস্থ হলে, তার মধ্যে ডায়বেটিসের অনেক লক্ষণ দেখা যাওয়া সত্ত্বেও অনেক চিকিৎসক ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করান না। অনেক ধরনের পরীক্ষা হয়, কিন্তু একমাত্র ডায়াবেটিসের পরীক্ষাটাই বাদ পড়ে যায় যেন। এ কারণে ছোটদের ডায়াবেটিস হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে না। যখন ধরা পড়ে, ততদিনে সমস্যার তীব্রতা বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিসের লক্ষণ

ছোটদের ডায়াবেটিসের কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত হলে অনেক ক্ষেত্রেই শিশু নেতিয়ে পড়ে। অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে যায়। পড়াশোনা, এমনকি খেলাধুলার প্রতিও আগ্রহ কমে যায়। উদ্যম হারিয়ে ফেলে।

ডায়াবেটিসের কারণে ঘন ঘন ক্ষুধা লাগতে পারে। পানির তৃষ্ণাও পাবে অনেক বেশি। বার বার শিশু বাথরুমে যেতে পারে।

কেন হয় ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস মূলত জিনগত কারণে হয়। পিতা-মাতা বা পূর্ব পুরুষের কারো ডায়াবেটিস থাকলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেশি থাকে।

Fast-Food-Obisity
ফাস্টফুড শিশুদের স্থুল বা অস্বাভাবিক মোটা করে তুলছে

তবে আমাদের জীবনধারা তথা লাইফস্টাইল বদলে যাওয়ার কারণেও ছোটদের মধ্যে  ডায়াবেটিসের প্রবণতা বাড়ছে, বিশেষ করে শহুরে শিশুদের মধ্যে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ওজন, তেল-চর্বি যুক্ত খাবার বেশি মাত্রায় খাওয়া, টেনশন ইত্যাদি ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী।

শহরের শিশুদের বড় অংশই কোনো শারীরিক পরিশ্রম করে না। এরা সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকে। না হয় কম্পিউটার, টিভির সামনে শুয়ে-বসে সময় কাটায়। এদের একটি অংশের পছন্দের খাবার হচ্ছে তেল-চর্বি সমৃদ্ধ কথিত ফাস্ট ফুড। ফলে এরা ওবিসিটি বা অতিরিক্ত ওজনের শিকার। স্কুলের পড়া, পরীক্ষা, অভিভাবকের চাপ ইত্যাদি কারণে এদের টেনশনেরও কমতি থাকে না। আর এগুলোই ডায়াবেটিসের জন্য যত্ন করে শরীরে বাসা বানিয়ে দেয়।

ডায়াবেটিস নিয়ে ভয় কেন

দুটি কারণে ডায়াবেটিস বেশ মারাত্মক। প্রথমত এটি শরীরের বাইরে থেকে আসা কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে সৃষ্ট রোগ নয়। ফলে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে বা নিষ্ক্রিয় করে রোগ সারিয়ে তোলার মতো ব্যবস্থা নেই। কিছু নিয়ম-কানুন মেনে আর ওষুধের (ক্ষেত্র বিশেষে ইনসুলিন, একেও ওষুধ বলা যায়) মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় মাত্র।

দ্বিতীয়ত এটি অনেক রোগের আঁধার।অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে দেশের রোগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া, কিডনি বিকল হওয়া, হার্ট ফেল ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে ডায়াবেটিস থেকে।

চাই সচেতনতা

ডায়েবেটিসের নাম শুনেই ভয় পেলে চলবে না। আর কিছু উপসর্গ দেখা দিলেই ডায়াবেটিস হয়েছে এমনটি ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং সচেতন হতে হবে। যেসব কারণে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়, সেগুলোকে এড়িয়ে চলতে হবে।

তারপরও কখনো ডায়াবেটিসের উপসর্গ দেখা গেলে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে। তার দেওয়া পরীক্ষা-নীরিক্ষাগুলো করিয়ে নিশ্চিত হতে হবে ডায়াবেটিস আছে কি না।

ডায়াবেটিস থাকলে চিকিৎসকের দেওয়া পরামর্শ ও ব্যবস্থা অনুসারে চলতে হবে। রোগের ধরন ও মাত্রা ভেদে খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিন দিতে পারে। সেগুলো নিয়মিত নিতে হবে।

তবে যত ওষুধই দিক না কেন, পরিশ্রমের চেয়ে বড় ওষুধ আর নেই। তাই পরিশ্রম করতে হবে। বাসায় একটু ব্যয়াম করতে পারলে অথবা পার্ক হেঁটে অনেক সুফল পাওয়া সম্ভব।

কী খাওয়া যাবে, কী যাবে না

কারো ডায়েবেটিস হলে চিকিৎসক নিশ্চয়ই বলে দেবেন, কী খাবার খাওয়া যাবে, আর কী খাওয়া যাবে না। তবু আমরা আগে থেকে কিছু বিষয় জেনে রাখতে পারি।

Local-Fruits
নানা স্বাদের দেশি ফল- লটকন, আমড়া, পেয়ারা, চালতা ও করমচা

প্রথমে বলি-ডায়াবেটিসকে এড়াতে কী কী খাওয়া উচিত নয়। ফাস্ট ফুড, অতিমাত্রায় তেল-চর্বিযুক্ত, ভাজা-পোড়া কিছু কম খাওয়া ভাল।

ডায়াবেটিস ধরা পড়লে উপরের খাবারগুলো একেবারে বাদ দিতে পারলে ভালো হয়। এছাড়া চিনি, কোল ড্রিংস, মিষ্টি, আইসক্রিম- মিষ্টি জাতীয় এসব জিনিস খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। আম, কাঁঠাল, কলাসহ মিষ্টি জাতীয় ফল খেতে হবে পরিমিত।

টক জাতীয় ফল প্রচুর পরিমাণে খাওয়া যাবে। পেয়ারা, আমলকি, আমড়া, কাঁচা আম, বাতাবি লেবু, করমচা, ডেওয়া, ডেফল, কাঁচা পেপে, বড়ই ইত্যাদিতে কোনো বাধা নেই। লাউ, শষাসহ বেশিরভাগ সব্জি ও শাক খাওয়া যাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে।

ভয়ের কিছু নেই

ডায়াবেটিস একটি মারাত্মক রোগ ঠিকই, তবে এটি নিয়ন্ত্রণে রেখে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। জীবনে সাফল্য লাভের ক্ষেত্রেও ডায়াবেটিস কোনো বড় বাধা হতে পারে না।ডায়াবেটিস নিয়েও খেলা, সঙ্গীত, সাহিত্য, অভিনয়সহ বিভিন্ন খাতে সাফল্যের শিখরে উঠেছেন, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়।

এক সময়ের জনপ্রিয় ক্রিকেটার ওয়াসিম আক্রাম ২৫ বছর বয়স থেকে ডায়বেটিসের জন্য ইনসুলিন নিতেন। কিন্তু তাতে তার বোলিংয়ের ধার এতটুকু কমেনি। তার বোলিংয়ের সামনে বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের বুকেও কাঁপন ধরত।

বিশ্বখ্যাত অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে শ্যারন স্টোন, এলিজাবেথ টেলর, টম হ্যাঙ্কস, সাহিত্যিক এইচ জি ওয়েলসের ডায়াবেটিস ছিল। হয়ত আরও মনীষীর এ রোগ ছিল। কিন্তু কোনো কারণে এটি গণমাধ্যম বা তাদের জীবনীতে উঠে আসেনি। তাছাড়া কয়েক দশক আগে ডায়াবেটিসের হার কম ছিল বলে এর প্রতি এত মনোযোগও ছিল না কারো।

জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হবে

ডায়াবেটিসকে এড়াতে কিংবা এ রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। বইয়ের পোঁকা হয়ে সারাদিন বই পড়া, টিভিতে মগ্ন হয়ে থাকা ভিডিও গেমস বা মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে না। এসবের পাশাপাশি কিছু কাজ করতে হবে। বাসার কাজে বাবা-মাকে সাহায্য করা, নিজের সেলফটি নিজেই গুছিয়ে রাখাসহ বিভিন্ন কাজ করলে শরীর থাকবে চাঙা, সতেজ। মাঠে খেলতে পারলে, সাইকেল চালাতে পারলেও কিন্তু দারুণ হয়। যদি বাসার বড়রা পার্কে হাঁটতে যায়, তাহলে তার সঙ্গী হলে মন্দ হয় না।

Village-Kids
গ্রামের শিশুরা সুযোগ পেলেই খেলায় মেতে উঠে। এ কারণে তাদের শরীর হয় মজবুত

স্কুল থেকে ফেরার পথে, আত্মীয় বা বন্ধুর বাসায় যাওা, কাছের দোকানে যাওয়া- এসব ক্ষেত্রে রিক্সা বা গাড়ির উপর এতো বেশি নির্ভর না করে মাঝেমধ্যে হাঁটা উচিত। অনেকের বাসা থেকে পা ফেলা মানেই রিক্সায় বা গাড়িতে চড়া। অনেক সময় অভিভাবকরা অতি আদরে আগলে রাখতে চান, সন্তানকে একটুও হাঁটতে দিতে চান না। তারা মনে করেন, এতে সন্তানের কষ্ট হবে।

School-Exercise
খেলার সুযোগ না হয়ে উঠলে স্কুলের মাঠেই একটু খেলে নেওয়া যায়

কিন্তু এই সামান্য কষ্ট এড়াতে গিয়ে কিন্তু অনেক সময় বড় কষ্টের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। তাছাড়া অভ্যেস হয়ে গেলে কিন্তু হাঁটার বিষয়টি আর কষ্টের থাকে না। এখনও গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে কয়েক মাইল হেঁটে স্কুলে যায়। তারা কিন্তু শহরের শিশুদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। এদের অসুখ-বিসুখও হয় কম।

আগেই আমরা আলোচনা করেছি কথিত ফাস্ট ফুড স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর। স্বাদ বদলাতে মাঝেমধ্যে এগুলো অল্প পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু নিয়মিত খাওয়া মানেই রোগকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা।

ফাস্ট ফুডের বদলে দেশীয় ফল খাওয়া অনেক ভালো। আমাদের দেশে কিন্তু নানা স্বাদের ফল আছে। এমন সমৃদ্ধ ফল ভাণ্ডার পৃথিবীর কম দেশেই আছে। হঠাৎ শহুরে হয়ে উঠা আমরা অনেকে দেশি ফলকে অবজ্ঞা করি। করমচা, ডেওয়া, ডেফল, বেতফল, চুকুরের মতো অনেক ফল হয়তো আমরা ঠিক চিনিই না। অথচ এসব ফল নানা ওষুধি গুণে পরিপূর্ণ।

আমরা এসব ফল খেতে শুরু করলে একদিকে নানা রোগ-জীবানু থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবো, অন্যদিকে এর ফলে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে এসব ফল।

মন্তব্য