চাকা এল কেমন করে?

2534
Wheels-Cronology
চাকার বিবর্তন

চাকা কি জিনিস তা কাউকেই বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। ছোটো-বড় সবাই জানে-চাকা হচ্ছে যানবাহনের গোল আকারের একটি যন্ত্রাংশ। এর উপর ভর করে যান তার অবস্থান পরিবর্তন করে।আর বর্তমানে শুধু যানবাহন নয়, আরও অনেক যন্ত্রেই চাকার ব্যবহার আছে।

তবে একটি জিনিস হয়তো অনেকেরই জানা নেই, চাকা হচ্ছে মানবসভ্যতাকে বদলে দেওয়া আবিষ্কারগুলোর একটি। চাকা আবিষ্কারের পর থেকেই নতুন গতিতে এগিয়েছে আমাদের সভ্যতা। আর এ কারণে চাকা আবিষ্কারকে মানবসভ্যতার একটি প্রাপ্তি হিসেবে দেখা হয়।

Before-Wheels
চাকা আবিষ্কারের আগে এভাবে গরু, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, লামার পিঠে পণ্য বহণ করা হত

চাকা আবিষ্কারের আগে কোনো ধরনের গাড়ির প্রচলন ছিল না। ফলে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হতো মাইলের পর মাইল পথ।

মানুষ কাঁধে করে, মাথায় নিয়ে অথবা ঘোড়ার মতো পালিত পশুর গায়ে চাপিয়ে মালামাল নিয়ে যেতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। এটি বেশন দুরুহ কাজ।

তারচেয়ে বড় কথা এভাবে পরিবহণে অনেক সময় প্রয়োজন। চাকা আবিষ্কারের পর ধীরে ধীরে এ সমস্যা কাটতে থাকে। চাকার উপর ভর করে আবিষ্কার হতে থাকে নানা ধরনের গাড়ি। মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহণ সবই হয়ে উঠে সহজ, দ্রুততর।

কবে কোথায় চাকা আবিষ্কার হয়, তার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, যিশুখৃষ্টের জন্মের ৫০০০ বছর আগে তথা আজ থেকে ৭০০০ বছরেরও বেশি আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় চাকা আবিষ্কৃত হয়। মেসোপটেমিয়া হচ্ছে ইরাক অঞ্চলের প্রাচীন এক সভ্যতার নাম।

Pottery
চাকা ঘুরিয়ে বানানো হচ্ছে মাটির পাত্র

ককেশাসের উত্তর দিকে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে, যাতে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেয়া হতো। ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যাতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে। এটিই এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরানো নিদর্শন বা চিহ্ন।

মনে করা হয়, গাছের গোল গুঁড়িকে গড়িয়ে যেতে দেখে চাকার ধারণা আসে মানুষের মাথায়। তারা গুঁড়িকে পাতলা করে কেটে তার মাঝখানে ছিদ্র করে লাঠির মতো কিছু দিয়ে চাকতি দুটিকে যুক্ত করেছে। আর তাতেই তৈরি হয়েছে আদিম গাড়ি।ওই গাড়ির সাথে বর্তমানের গরুর গাড়ির কিছুটা মিল থাকতে পারে।

পরবর্তীতে নানাভাবে চাকার বিবর্তন হয়েছে। কাঠের চাকা দ্রুত ক্ষয়ে যাওয়া এবং ফেটে যাওয়ায় এতে লোহার পাতলা পাত লাগানো হয়। এক পর্যায়ে পাতের জায়গা দখল করে পাতলা রাবার। সর্বশেষ রাবারের চাকা ও টিউব আবিষ্কৃত হয়।

Standard_of_Ur_chariots
সুমেরীয় সভ্যতার একটি নিদর্শন। চাকায় চালিত যুদ্ধের রথের ছবি

বর্তমানে শুধু গাড়ি নয়, নানা ধরনের যন্ত্রে চাকার ব্যবহার আছে। সুতা কাটার চরকা, ভারি জিনিস তোলার কপিকল, গিয়ার- ইত্যাদি চাকারই পরিবর্তিতরূপ।

Wheel_Iran
ইরানের জাদুঘরে সংরক্ষিত স্পোকযুক্ত চাকা। অনুমান করা হয় এটি খৃস্ট জন্মের ২ হাজার বছর আগের

খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দ নাগাদ চাকার ব্যবহার ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় চাকার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের দিকে। চীনে চাকার ব্যবহার দেখা যায় ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, যখন চাকাযুক্ত গাড়ির প্রচলন হয়। তবে ঐতিহাসিক বারবিয়েরি-লো (২০০০) এর মতে আরো পূর্বে খ্রিষ্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের দিকে চীনে চাকার প্রচলন ছিলো।

প্রাচীন নুবিয়াতে চাকা ব্যবহার করা হতো মাটির হাড়ি ও পাত্র তৈরীতে, এবং পানি উত্তোলনে। নুবিয়ার পানি উত্তোলনে ব্যবহৃত চাকাগুলো ঘুরানো হতো গবাদিপশু দিয়ে।

শুরুতে চাকা নির্মাণ করা হতো শুধু কাঠের চাকতি দিয়ে। স্পোকযুক্ত চাকার উদ্ভাবন হয়েছে বেশ পরে। এই চাকার ব্যবহারে গাড়ির ওজন কমে হালকা হয়। এতে এর গতি বাড়ে। প্রায় ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আন্দ্রোনভ সংস্কৃতিতে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার পাওয়া যায়। এর অল্প পড়েই ককেশাস এলাকার অধিবাসীরা ঘোড়ার গাড়িতে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার শুরু করে। মূলত যুদ্ধে ব্যবহৃত রথে এধরণের চাকা তারা ব্যবহার করতো।

ওই এলাকা থেকে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে গ্রিক উপদ্বীপে। খ্রিষ্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দ নাগাদ কেল্টিকদের রথগুলোতে এমন চাকা ব্যবহার করা যেতো, যার পরিধি বরাবর লোহার বেষ্টনি দেয়া থাকতো। ফলে এ ধরণের চাকাগুলো অনেক মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হতো। স্পোকযুক্ত চাকা এভাবেই প্রায় অপরিবপর্তিত অবস্থাতে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্যবহৃত হয়ে আসে। ১৮৭০ খ্রিঃ এর দিকে চাকায় নিউম্যাটিক টায়ার ব্যবহার করা শুরু হয়।

মন্তব্য